ড. মুহাম্মদ ইউনুসের জীবন বৃত্তান্ত ।

ড. মুহাম্মদ ইউনুসের জীবন বৃত্তান্ত।


ড. মুহাম্মদ ইউনুস একজন বিশিষ্ট বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ এবং সমাজসেবক, যিনি ক্ষুদ্রঋণ (মাইক্রোক্রেডিট) ও গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছেন। তিনি ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

ড. ইউনুসের মূল অবদান হলো গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা, যা ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষ, বিশেষত মহিলাদের, আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়তা করে। ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংক দারিদ্র্য বিমোচনে একটি বিপ্লবী ধারণা হিসেবে কাজ করেছে। সাধারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা যেখানে জামানত ছাড়া ঋণ দেয় না, সেখানে গ্রামীণ ব্যাংক জামানত ছাড়াই ঋণ প্রদান করে এবং তার ঋণ পরিশোধের হার অত্যন্ত বেশি। তার এই ক্ষুদ্রঋণ মডেল দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে এবং বিভিন্ন দেশে গ্রহণ করা হয়েছে।

২০০৬ সালে, ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল সম্মান এবং ড. ইউনুসকে "ব্যাংকার টু দ্য পুওর" উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তার কাজের জন্য তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

ড. ইউনুসের প্রকাশিত বই।

ড. ইউনুসের বই **"ব্যাংকার টু দ্য পুওর"** বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যেখানে তিনি ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব এবং দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানো উচিত।

ড. মুহাম্মদ ইউনুসের জীবন ও কর্ম কেবল ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি সামাজিক ব্যবসা (social business) ধারণারও প্রবর্তক। সামাজিক ব্যবসা হলো একটি বিশেষ ধরনের উদ্যোগ যেখানে মুনাফা অর্জন করাই প্রধান লক্ষ্য নয়, বরং সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যবসা করা হয়। এই মডেলের মাধ্যমে তিনি দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং পরিবেশগত সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা বলেছেন। ২০০৭ সালে তিনি **"সোশ্যাল বিজনেস"** ধারণা প্রথম তুলে ধরেন এবং এটি দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

সামাজিক ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য

সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে ড. ইউনুস একটি এমন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চেয়েছেন যেখানে উদ্যোক্তারা সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবে। এখানে বিনিয়োগকারীরা তাদের মূলধন ফেরত পান, কিন্তু মুনাফা ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেন না; বরং তা আবার ব্যবসার সম্প্রসারণে বিনিয়োগ করা হয়। তার প্রতিষ্ঠিত **ইউনুস সেন্টার** সামাজিক ব্যবসা প্রচার এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

ইউনুসের আন্তর্জাতিক প্রভাব

ড. ইউনুস শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং সারা বিশ্বে তার কাজের জন্য সম্মানিত। তার ক্ষুদ্রঋণ মডেল আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দরিদ্র দেশে সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তার ক্ষুদ্রঋণ ধারণাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং বিভিন্ন দেশ এ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

সমালোচনা ও বিতর্ক

তবে ড. ইউনুসের কাজের প্রশংসার পাশাপাশি কিছু সমালোচনাও রয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার কিছু সীমাবদ্ধতা ও কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে তাকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকারের সাথে তার কিছু মতবিরোধের কারণে তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল। তবে এর ফলে তার সারা বিশ্বে প্রতিপত্তি বা সম্মান কমে যায়নি। বরং তিনি সামাজিক ব্যবসা, শিক্ষামূলক কার্যক্রম এবং বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।

ড. ইউনুসের সম্মাননা ও পুরস্কার

  • ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
  • নোবেল শান্তি পুরস্কার (২০০৬) – দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য তার অবদানের স্বীকৃতি।
  • যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের স্বাধীনতা পদক (২০০৯) – মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কর্তৃক প্রদত্ত এই পদকটি সমাজসেবায় তার অবদানের জন্য।
  • কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল (২০১৩) – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তার অবদানের জন্য।
  • আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মাননা – জাপান, ফ্রান্স, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ

বর্তমানে ড. ইউনুস বিশ্বের নানা প্রান্তে তার সোশ্যাল বিজনেস ধারণা নিয়ে কাজ করছেন এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করছেন সামাজিক সমস্যা সমাধানে। তার **"থ্রি জিরো"** ভিশন (Zero Poverty, Zero Unemployment, and Zero Net Carbon Emissions) বিশ্বব্যাপী প্রশংসা পাচ্ছে। তিনি বিশ্বাস করেন যে এই ভিশনের মাধ্যমে পৃথিবীকে আরও শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ করা সম্ভব। 

ড. ইউনুসের জীবন ও কাজ থেকে প্রেরণা নিয়ে অনেক মানুষ আজ সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ডিজিটাল সাকসেস আইটির নিতীমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪