বন্যায় বিপর্যস্ত জনপদ মানুষের বাঁচার আকুতি ।
বন্যায় বিপর্যস্ত জনপদ।
অতিবৃষ্টি এবং উজান থেকে আসা ঢলে বিভিন্ন জেলায় এখন পর্যন্ত ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ১৩ জন পুরুষ, দুজন নারী। কুমিল্লায় চারজন, চট্টগ্রামে চারজন, কক্সবাজারে তিনজন, ফেনীতে একজন, নোয়াখালীতে একজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন ও লক্ষ্মীপুরে একজন।
কুমিল্লা ও চৌদ্দগ্রামঃ ভারত থেকে নেমে আসা ঢল ও টানা বর্ষণের কারণে ফেনী জেলায় সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পানিতে ভাসছে জেলা শহরও।
স্থানীয় লোকজন বলছে, তারা এমন ভয়াবহ বন্যা আগে কখনো দেখেনি। বিশেষ করে ফেনী শহরে পানি ওঠায় রীতিমতো অবাক তারা।
পানিবন্দি হয়ে জেলার কয়েক লাখ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বানভাসি মানুষকে উদ্ধারে কাজ করছে সেনা ও নৌবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। গতকাল সকালে ফেনী সদরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ স্থানেই পানিতে ডুবে আছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও ফসলের জমি।
অনেক গ্রামে বাড়িঘর খালি পড়ে আছে। বেশির ভাগ ভবনের নিচতলায় পানি ঢুকেছে। কেউ কেউ দোতলা ও তিন তলায় আশ্রয় নিয়েছে। ভেসে গেছে বেশির ভাগ পুকুর ও জলাশয়ের মাছ। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশে কোথাও হাঁটু সমান আবার কোথাও বুক সমান পানি। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাবে অনাহারে দিন কাটছে অনেকের। ত্রাণের অপেক্ষায় দিন কাটছে কারো কারো।
এদিকে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়েছে কুমিল্লায়। ভারত থেকে আসা পানি ও কয়েক দিনের টানা বর্ষণে বুড়িচং উপজেলায় গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে ৯টি ইউনিয়নই প্লাবিত হয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দিশাহারা হয়ে পড়েছে মানুষ।
গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া গ্রামের কাছে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। গতকাল দুপুর ২টার মধ্যে পুরো উপজেলা প্লাবিত হয়ে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড, কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান জানান, গতকাল বিকেল ৩টায় গোমতীর পানি বিপৎসীমার ১০৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
গাজীপুর গ্রামের সালমা হক বলেন, ‘আমাদের বাসার মালপত্র ছাদের ওপরে রেখেছি। পানি বাড়ছে। আমার মাকে নিয়ে কুমিল্লা শহরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া সড়কে পানি ওঠায় যান চলাচল বন্ধ। বলতে গেলে চরম দুর্ভোগে পড়েছি। এলাকার সব বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছে পানি।
কুমিল্লায় চারজনের মৃত্যুঃ কুমিল্লায় দুই দিনে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার মারা যান তিনজন, সোমবার মারা গেছেন একজন। দুজন বিদ্যুৎস্পৃষ্টে, একজনের মাথায় গাছ পড়ে, একজন পানিতে তলিয়ে মারা যান। নাঙ্গলকোটে বন্যার পানিতে তলিয়ে কেরামত আলী (৪৫) নামে এক ব্যক্তি মারা যান। বুধবার রাতে তার মৃত্যু হয়। ওইদিন বিকালে বৃষ্টির মধ্যে বৈদ্যুতিক পিলারের সঙ্গে লেগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে রাফি (১৫) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। চৌদ্দগ্রামে বন্যার পানিতে মাছ ধরার সময় গাছ পড়ে শাহাদাত হোসেন (৩৪) নামে এক প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে। কুমিল্লা নগরীর সালাউদ্দিন মোড়ে সোহরাব হোসেন সোহাগ নামে এক আইনজীবীর মৃত্যু হয়েছে।
ফটিকছড়িঃ ফটিকছড়ি উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের সবই প্লাবিত। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ১৮টি ইউনিয়নের জন্য ১৮ জন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। ৩৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সীতাকুণ্ডঃ সীতাকুণ্ডের ছয় ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ৫ হাজার পরিবারের প্রায় ২০ হাজার জন পানিবন্দি।
বাঁশখালীঃ বাঁশখালী উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ১ হাজার ৭৫০ পরিবারের ৮ হাজার ৭৫০ জন মানুষ। উপজেলায় গঠন করা হয়েছে ১৫টি মেডিকেল টিম।
রাউজানঃ উপজেলার ৩২০ পরিবারের ১৬০০ মানুষ পানিবন্দি।
হাটহাজারীঃ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম মশিউজ্জামান জানান, উপজেলার প্রায় আটটি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি রয়েছেন প্রায় অর্ধলাখ মানুষ।
পটিয়া, বোয়ালখালী ও কর্ণফুলী : পটিয়া উপজেলার ইউনিয়ন, পৌরসভা ও ওয়ার্ড মিলিয়ে ১৮ স্থানে ৬ হাজার ৯৪৬ পরিবারের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। বোয়ালখালী উপজেলার ৩ জায়গায় ১০০ পরিবারের প্রায় ৭০০ মানুষ পানিবন্দি আছে। কর্ণফুলী উপজেলায় ১০০ পরিবারের প্রায় ৫০০ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন।
নোয়াখালীঃ নোয়াখালীর ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি। তাদের বেশির ভাগই খাবার ও বাসস্থানের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জেলার ৯ উপজেলার সবকটিতেই বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। জানা গেছে, সুবর্ণচর, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল, বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর ও সদর উপজেলার বেশির ভাগ নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক উচ্চতায় জোয়ার হয়েছে। ফলে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা।
লক্ষ্মীপুরঃ বন্যায় বিপর্যস্ত এখন লক্ষ্মীপুরের মানুষ। প্লাবিত হয়েছে শতাধিক গ্রাম। এতে জেলার পাঁচটি উপজেলার সাড়ে ৬ লাখেরও বেশি মানুষ এখন পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। মেঘনা, ডাকাতিয়া ও রহমতখালী নদীর পানি এখন বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। গতকাল সকাল থেকে পানি বেড়েছে আরও ২-৩ ফুট। হু হু করে পানি বেড়ে ডুবে গেছে নিম্নাঞ্চলের মানুষের বসতঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ। ভেসে গেছে পুকুর ও জলাশয়ের মাছ। গ্রাম কিংবা শহর চারদিকে থইথই করছে পানি। প্লাবিত এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে কমলনগর, রামগতি, সদর ও রায়পুরে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াঃ আখাউড়ায় কমতে শুরু করেছে ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের তীব্রতা। ফলে পানি কমতে শুরু করেছে। গতকাল সকাল থেকে আখাউড়ার গাজীবাজার, মোগড়া, মনিয়ন্দসহ বিভিন্ন গ্রামের ডুবে থাকা বাড়িগুলো থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুপুরনাগাদ দেড় থেকে ২ ফুট পানি কমে গেছে। অনেকে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। দু-এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশা করা হচ্ছে। এদিকে পানি কমলেও স্রোতের তোড়ে আখাউড়া-কসবা সড়কের দেবগ্রাম ও নয়াদিল এলাকা ভাগ করা একটি ছোট্ট সেতুর একপাশ ধসে যায়।
কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) ঃ কয়েক দিনের অবিরাম বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে কুলাউড়া উপজেলায় মনু নদের বাঁধে তিনটি স্থান ভেঙে টিলাগাঁও ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ার পর নতুন করে আরো অর্ধশতাধিক গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। প্লাবিত হয়েছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও ফসলের জমি। এদিকে ঢল ও জুড়ী নদীর পানি হাকালুকি হাওরে প্রবেশ করায় হাওরের পানি ক্রমেই বাড়ছে। পানি ঢুকেছে কুলাউড়া পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে। উপজেলা পরিষদ সড়কে রয়েছে হাঁটুপানি।
মৌলভীবাজার পাউবো জানিয়েছে, গতকাল সকাল ৯টার তথ্যানুযায়ী মনু নদের পানি হাজীপুর ইউনিয়নের রেল ব্রিজ এলাকায় বিপৎসীমার ২৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সন্ধ্যা ৬টায় ৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জুড়ী উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত জুড়ী নদীর পানি ১৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কুলাউড়া ক্যাম্পের একটি টিম স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে দুর্গত মানুষকে উদ্ধারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ডিজিটাল সাকসেস আইটির নিতীমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url