কুরবানির পশু কেমন হওয়া উচিত? কেমন পশু কিনব?
কুরবানি শব্দের অর্থ কি?
কুরবানি শব্দের মূল অর্থ নৈকট্য লাভ বা আল্লাহর সান্নিধ্যে পাওয়া। আরবি ভাষার "কুরব" (قرب) শব্দ থেকে এটি উদ্ভূত, যার অর্থ "নিকটে আসা"।
ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে, কুরবানি বলতে বোঝায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পশুবলি। ইসলামে ঈদুল আযহার সময় গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পশু যবাহ করার নামই কুরবানি। কুরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা, আনুগত্য এবং ত্যাগের প্রকাশ করে।
"কুরবানি" শব্দটি আরবি "قربان" (কুরবান) থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ "বলিদান" বা "উৎসর্গ"। ইসলামী প্রথায়, কুরবানি বলতে বোঝায় ঈদুল আযহা উপলক্ষে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু জবাই করার বিশেষ ধর্মীয় আচার। এটি হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর পুত্র ইসমাইল (আঃ) কে আল্লাহর নির্দেশে উৎসর্গ করতে চাওয়ার ঘটনাকে স্মরণ করায়। আল্লাহর প্রতি তাঁর আস্থা ও আনুগত্যের পরীক্ষার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এই প্রথা পালিত হয়, যা মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কুরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের সম্পদ, বিশ্বাস এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে।
কুরবানির কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিম্নে লিখা হল।
- কৃতজ্ঞতা প্রকাশঃ আল্লাহ যে সকল নেয়ামত দান করেছেন তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য মুসলমানরা কুরবানি করে।
- আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনঃ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং জান্নাত লাভের আশায় মুসলমানরা কুরবানি করে।
- ত্যাগের প্রকাশঃ আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও আনুগত্যের প্রমাণ হিসেবে মুসলমানরা তাদের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস, যেমন পশু, আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে।
- সাহায্যের উদ্দেশ্যঃ কুরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগ নিজেদের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনদের জন্য এবং বাকি অংশ গরিব ও অভাবীদের জন্য।
কুরবানি শুধুমাত্র পশুবলি নয়, বরং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, আনুগত্য ও ত্যাগের বহিঃ প্রকাশের একটি মাধ্যম।
কাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব করা হয়েছে?
ইসলামে কুরবানি ফরজ নয়, বরং ওয়াজিব বা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পালনের নির্দেশ দেওয়া একটি সুন্নত। নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের উপর কুরবানি করা ওয়াজিব। কুরবানি করার দায়িত্ব ব্যক্তি মুসলিমের উপর বর্তায় এবং ঈদুল আযহার সময় তা পালন করতে হয়।
- মুসলিম হওয়াঃকুরবানি শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব।
- বালিগঃ শিশুদের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়।
- আকিল বা বুদ্ধিমান হওয়াঃ মানসিক ভারসাম্যহীন বা পাগল ব্যক্তির উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়।
- স্থায়ী বাসিন্দা হওয়াঃ মুসাফিরদের (ভ্রমণকারীদের) উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়।
- আর্থিক সামর্থ্য থাকাঃ নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া, যাকে ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী 'নিসাব' বলে। অর্থাৎ, যার কাছে প্রয়োজনীয় খরচাপাতি বাদ দিয়ে সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা বা এর সমপরিমাণ সম্পদ থাকে, তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হয়।
- প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম: যারা বিচার-বিবেচনা করতে সক্ষম এবং নিজের খরচ বাদে নিসাব পরিমাণ সম্পদ রাখে।
- মুসাফির না হওয়া: কোরবানির দিন যাত্রা করেননি।
নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে নিম্নে তা উল্লেখ করা হল।
- নিজের খরচ বাদে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে।
- নিসাব হলো ৫২.৫ ভরি রুপার সমমান মূল্যের স্বর্ণ, রুপা, নগদ টাকা, বা অন্যান্য সম্পদ।
- জমি, বাড়ি, গাড়ি ইত্যাদির মূল্যও নিসাব হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
- জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সূর্যোদয়ের পূর্বে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা হিসাব।
- এই শর্ত পূরণ না হলে ওয়াজিব হবে না।
উল্লেখ্য বিষয় গুল হল।
- অনেক আলেমের মতে, কোরবানি ওয়াজিব নয়, সুন্নত মুয়াক্কাদা।
- ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির উপর কোরবানি ওয়াজিব নয়।
- নারীদের উপরও কোরবানি ওয়াজিব, তবে পুরুষদের উপর নারীদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব।
- পরিবারের সকলের জন্য একসাথে একটি কোরবানি দেওয়া যথেষ্ট, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা করতে হবে।
কুরবানির পশু কেমন হওয়া উচিত?
ইসলামী শরীয়ত অনুসারে, কুরবানির পশুতে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি থাকা উচিত ।
কুরবানির পশুর বয়স।
- উট: ৫ বছর পূর্ণ
- গরু/মহিষ: ২ বছর পূর্ণছাগল/ভেড়া/দুম্বা: ১ বছর পূর্ণ
- ষাঁড়: ২ বছর পূর্ণ হলেও, ৩ বছর পূর্ণ হলে উত্তম
পশুর শারীরিক অবস্থা।
- তরতাজা ও হৃষ্টপুষ্টঃ রোগাক্রান্ত, দুর্বল বা খুঁতযুক্ত পশু কোরবানির জন্য উপযুক্ত নয়।
- সুস্থঃ কোনো দীর্ঘমেয়াদী বা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত পশু কোরবানির জন্য উপযুক্ত নয়।
- খুঁতমুক্তঃ নিম্নলিখিত খুঁতগুলি থাকলে পশু কোরবানির জন্য યોગ્ય নয়:
- অন্ধতাঃ উভয় চোখ বা একটি চোখ অন্ধ হলে।
- খোঁড়াঃ তিন পায়ে হাঁটা বা এক পা ভেঙে বা পঙ্গু হলে।
- শিংহীনঃ উভয় শিং বা একটি শিং মূল থেকে ভেঙে গেলে।
- লেজবিহীনঃ লেজের বেশিরভাগ অংশ কাটা থাকলে।
- অস্বাভাবিক চলাফেরাঃ পায়ের হাড় ভেঙে বা অস্বাভাবিকভাবে হাঁটলে।
- গুরুতর রোগঃ যেমন, চুলকানি-পাচড়া, যক্ষ্মা, মুখ-পায়ে ঘা ইত্যাদি।
কুরবানির পশু নির্বাচন করতে যে কয়েকটি বিষয় মনে রাখা উচিত?
- একজন ব্যক্তি একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দিয়ে কোরবানি করতে পারেন।
- একটি উট বা গরু সাতজনের মধ্যে ভাগ করে কোরবানি করা যাবে।
- কোরবানির পশু যবহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা আবশ্যক।
- কোরবানির গোশত নিজে খাওয়া, গরিবদের বিতরণ করা এবং আত্মীয়স্বজনদের উপহার দেওয়া উত্তম।
- স্বাস্থ্যসম্মত পশুর নির্বাচনঃ কুরবানির জন্য সুস্থ এবং ভালো কন্ডিশনের পশু নির্বাচন করা উচিত। পশুর শারীরিক অবস্থা, উম্মেদিত আয়ু, রং, মোটায় গঠন, চিকনগুন, ব্রিডিং ইত্যাদি বিবেচনা করা উচিত।
আরো পড়ূনঃএশিয়া মহাদেশে বাংলাদেশের অবস্থান?
- মানুষের প্রয়োজনে পশুর দরকার: কুরবানির পশু নির্বাচনে মানুষের প্রয়োজনে অবশ্যই মনে রাখতে হবে। কিছু স্থানে গরীব মানুষের কাছে পর্যাপ্ত প্রোটিন সরবরাহে সাহায্য করার জন্য বড় পশু নির্বাচন করা উচিত।
- সমান পরিমাণের সাহায্যঃ সমান পরিমাণের পশু নির্বাচন করা উচিত যাতে সমান সংখ্যক মানুষ প্রতি পশু থেকে সামান্য পরিমাণে মাংস পাওয়া যায়।
- ধর্মীয় গুরুত্বঃ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে, কুরবানির পশু নির্বাচনে ইসলামিক নির্দেশিকা মেনে চলা উচিত। কুরবানির পশু সঠিক প্রকারের শত্রু সংক্ষেপনের জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।
- পশুর যত্নঃ কুরবানির পশুর পরিচর্যা এবং যত্নের সঠিক প্রস্তুতি নিশ্চিত করা উচিত। তাদের ভালো খাবার, পানি, পরিচর্যা ইত্যাদি প্রয়োজন।
এই সমস্ত বিষয়গুলি মনে রেখে কুরবানির পশু নির্বাচন করা উচিত।
কুরবানির ফজিলত কেমন?
কুরবানির ফজিলত ইসলামে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। এটি একটি বিশেষভাবে ধর্মীয় এবং সামাজিক গুরুত্ব রাখে। কুরবানির ফজিলত সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
- ইবাদতের ফজিলত: কুরবানি ইসলামে একটি প্রধান ইবাদত হিসাবে গণ্য হয়। এটি মুসলিমদের আল্লাহর পক্ষ থেকে বন্ধুত্ব, আবেগ এবং ধর্মীয় যাতনার একটি প্রতীক।
- ধর্মীয় মূল্য: কুরবানির প্রক্রিয়া মুসলিম ধর্মের মূল্য ও সিদ্ধান্তের সাথে মিলে। এটি তাদের আল্লাহর অনুসরণ এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নেতৃত্বের চিহ্ন।
- সামাজিক মূল্য: কুরবানি একটি সামাজিক ঘটনা হিসাবে গণ্য হয়, যা মানুষের সমস্ত বাহ্যিক এবং আধ্যাত্মিক দরিদ্রতা থেকে রক্ষা করে। এটি সমাজের সহানুভূতি, দয়া এবং প্রত্যাশা বৃদ্ধি করে।
- আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠান: কুরবানি একটি সাক্ষাৎকার এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমোদনের প্রতীক। এটি মুসলিমদের অকীকরণ প্রক্রিয়ার একটি অংশ।
ইসলামে কুরবানি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ পাক সূরা হজ্বের আয়াত 37-এ বলেছেন, "তাদের মাংস এবং রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, বরং তোমাদের তাকওয়া আল্লাহর কাছে পৌঁছায়।
কুরবানির কিছু ফজিলত হল।
- আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনঃ কুরবানি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
- গুনাহের ক্ষমাঃ কুরবানি গুনাহের ক্ষমা লাভের উত্তম উপায়।
- জান্নাতের পথ প্রশস্ত করাঃ কুরবানি জান্নাতে যাওয়ার পথকে প্রশস্ত করে।
- দুঃখ-কষ্ট দূরীকরণঃ কুরবানি দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদ দূর করতে সাহায্য করে।
- গরিবদের সাহায্যঃ কুরবানির গোশত গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হলে তা তাদের জন্য বড় সাহায হয়।
- আত্মত্যাগ ও ত্যাগের শিক্ষাঃ কুরবানি আত্মত্যাগ ও ত্যাগের শিক্ষা দেয়।
- পশুদের উপর সহানুভূতিঃ কুরবানি পশুদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি ও করুণার বোধ জাগ্রত করে।সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধিঃ কুরবানি সামাজিক সম্প্রীতি ও ঐক্য বৃদ্ধি করে।
কুরবানি সর্ম্পকে কিছু হাদিস।
হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, "কোরবানির পশুর প্রতিটি লোমের পরিবর্তে (একটি করে) নেকি রয়েছে।" (মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, "কোরবানির পশুর প্রথম পদক্ষেপ যখন জবাহের স্থানে পা রাখে, তখন তার সকল গুনাহ ঝরে পড়ে যায়।" (তিরমিযি)
হজরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, "কোরবানির গোশত খাওয়ার পর যতক্ষণ না তুমি অন্য কোনো গোশত খাও, ততক্ষণ তোমার জন্য সওয়াব লেখা হবে।" (তিরমিযি)
উপসংহারঃকুরবানি একটি মহান ইবাদত যা আমাদের আল্লাহর নৈকট্য অর্জন, গুনাহের ক্ষমা লাভ, জান্নাতের পথ প্রশস্ত করা এবং আরও অনেক কিছুতে সাহায্য করে। তাই, সামর্থ্য থাকলে সকল মুসলমানের উচিত নিয়মিতভাবে কুরবানি করা।
জানুন আপনার কাজে লাগবে